কোচবিহারের (ভারত) সাহিত্য পত্রিকা ও প্রকাশনা ‘বিরক্তিকর’ এর উদ্যোগে ৭ ফেব্রুয়ারি (২০২১) অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘অরুণেশ ঘোষ স্মৃতি স্মারক বক্তৃতা’৷ বক্তা ছিলেন শুভময় সরকার৷ অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে ২৭ জুলাই তিনি তার ফেসবুক টাইমলাইনে নিম্নোক্ত অনুভূতি প্রকাশ করেছেনঃ
গত ৭ই ফেব্রুয়ারী ‘বিরক্তিকর’ পত্রিকার আমন্ত্রণে রাজনগর কোচবিহারে ‘অরুণেশ ঘোষ স্মৃতি স্মারক বক্তৃতা’ বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠান হয়েছিল সাহিত্যসভা হলঘরে।বাঘাবাঘা সব শ্রোতাদের সামনে বলতে গিয়ে কিছুটা চাপে তো ছিলামই, কিন্তু বক্তৃতা শেষে স্বতঃস্ফূর্ত হাততালিতে মনে হলো একেবারে বাজে বলিনি। অরুণেশদাকে আমি আমার মতো করে বিশ্লেষণ করেছিলাম সেদিন।গতকাল ‘বিরক্তিকর’ পত্রিকার পক্ষ থেকে জানানো হলো আমার সেই বক্তব্য আসছে এবার দু'মলাটে...!আমি খুব খুশি। আমার আলোচনা সবার ভালো লেগেছে জেনে এই আনন্দ স্বাভাবিক।কৃতজ্ঞতা জানাই টিম বিরক্তিকরকে। যারা এই পত্রিকার সঙ্গে আছেন— হ্যাটস অফ।অরুণেশ ঘোষের এই স্কেচটির জন্য প্রিয় শিল্পী শ্রীহরি দত্তকে স্যালুট।
কবি অরুণেশ ঘোষের জীবনী
মেকি ভদ্র লোকের সংস্কৃতি মাড়িয়ে একজন সন্ত ও একজন কবি কীভাবে লেলিহান বহ্নুৎপাতের দিনে পুড়ে যেতে চায় তা অরুণেশ ঘোষ দিয়ে বুঝতে হয়। এবং অরুণেশ কেবল নামমাত্র নন, তিনি এই তাবৎ ধান্দাবাজির জগতে প্রবল একগুঁয়ে জেদি ও তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির পরােয়া না করা একজন লেখক। গঙ্গেশচন্দ্র ঘােষ ও শান্তিসুধা ঘােষের পুত্র অরুণেশের জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯৪১, মৃত্যু ২৪ আগস্ট ২০১১। এ পর্যন্ত তার ২০টিরও বেশি বই প্রকাশিত। কবি শৈলেশ্বর ঘােষের বিশেষ উদ্যোগে ১৯৮১ সালে অরুণেশের সাড়াজাগানাে কাব্যগ্রন্থ ‘শব ও সন্ন্যাসী’ প্রকাশিত হয়। অরুণেশ সেই বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত প্রান্তিক মানুষজনেদের একজন যিনি আশ্চর্যভাবে বাংলা কবিতাকে সাবালক করলেন ফরাসি কবি জাঁ আর্তুর ব়্যাবোকে বাংলায় অনুবাদ করে। সামাজিক সমঝােতা ও ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা যেভাবে প্রলুব্ধ রাখে একজন লেখককে খুব কম জনই নিজেকে তা থেকে মুক্ত রাখতে পারেন, স্বীকৃতি নামক অলীক মায়া কবচ গলায় না ঝুলিয়েও দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারেন একটা মানুষজীবন মুহূর্তের বিচ্যুতি না ঘটিয়েও। ২০০৬-এরপর থেকে কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে অরুণেশকে সম্মানিত করা হয়। এগুলির মধ্যে সারস্বত সম্মান, বিবৃতি এবং বিকল্প কবি জীবনানন্দ স্মারক সম্মান দরিয়া, সৃজন সম্মান উল্লেখযােগ্য। অরুণেশ মরণোত্তর বর্ণপরিচয়-সংবাদ প্রতিদিন সম্মান (২০১১) ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সম্মান (২০১২)-এ সম্মানিত করা হয়।
১৯৬৫ সালে কয়েকজন আন্দোলনকারী হাংরি মামলায় যখন রাজসাক্ষী হয়ে যান, আন্দোলনটি ভেঙে গিয়েছিল। সাত দশকের মাঝামাঝি অরুণেশ ঘোষ লিটল ম্যাগাজিন ‘জিরাফ’ প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকে পুনরায় জীবিত করে তোলার প্রয়াস করেন।
তিনি উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার হাওয়ার গাড়ি গ্রামে বসবাস করতেন এবং নতুন হাংরি আন্দোলনকে জীবিত করে তোলার প্রয়াসে উত্তরবঙ্গে প্রায় কুড়ি জন কবি ও লেখককে উদ্বুদ্ধ করেন। নতুন হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে পরবর্তীকালে যাঁরা খ্যাত হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কথাসাহিত্যিক অলোক গোস্বামী, এবং কবি রাজা সরকার, নিত্য মালাকার, জীবতোষ দাশ, সমীরণ ঘোষ, মনোজ রাউত, বিকাশ সরকার, সুব্রত তায়, নকুল মণ্ডল, তনুময় সরকার, দিবাকার ভট্টাচার্য, বিজয় দে, অন্যমন দাশগুপ্ত, জামালুদ্দীন, অনুভব সরকার, রাজীব সিংহ, মলয় মজুমদার, সুমন্ত ভট্টাচার্য, অরুণ বণিক, সেলিম মুস্তফা, রসরাজ নাথ প্রমুখ। উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি প্রতিষ্ঠা-লোভ ও খ্যাতির মোহ ত্যাগ করে সারাজীবন নিজের গ্রামে বুনিয়াদি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। গ্রাম ছেড়ে যেতে চাননি কলকাতায়। গ্রামের বাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারের তিনিই ছিলেন কর্তাব্যক্তি। সে কারণে বন্ধুরা তাকে রসিকতা করে ‘ব্যতিক্রমী গৃহস্থ কবি’ সম্বোধন করতেন। তিনি বিশিষ্ট সাঁতারু ছিলেন কিন্তু তা সত্ত্বেও পুকুরে স্নান করার সময়ে জলে ডুবে মারা যান। তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন কিনা এ-বিষয়ে আলোচকদের মাঝে সংশয় আছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত ছিলেন এই কবি। অনেকে মনে করেন যে তিনি শেষ জীবনে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।
অরুণেশ ঘোষের বইয়ের তালিকা |
নতুন ধারার হাংরি কবিরা অরুণেশ ঘোষের নেতৃত্বে কবিতাকে নতুন ধারায় চালিত করার প্রয়াস করেছিলেন। কলকাতা মেট্রোপলিস থেকে বহুদূরে সম্পূর্ণ গ্রামীণ পটভূমিতে তারা নিয়ে এসেছিলেন গ্রাম ও গঞ্জের পাগল, গণিকা, মাতাল পুরুষ, বেশ্যালয়ের উঠোন, নগ্ন কিশোর, দালাল, ধর্ষক, খুনি, অপরাথী, সন্ন্যাসী, বিকলাঘ্ প্রসবঘর, ভাটিখানা, সিফিলিস, বেশ্যার সন্তান, গর্ভফুল, ভবঘুরে, গ্রামীণ রাজনীতি, দলতন্ত্র, ক্যাডারদের অত্যাচার, শ্মশান ইত্যাদির এক বহুরৈখিক সহাবস্থানের সন্ধান করেছেন তারা তাদের রচনায়। প্রথম পর্বের হাংরি কবিদের রচনায় যৌনতা ছিল মূলত শব্দের। নতুন পর্বের হাংরি আন্দোলনকারীরা আনলেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জারিত জীবনযাত্রা। ব্যক্তিমানুষের প্রান্তিক অস্তিত্ব, কৌম জীবনের ব্রাত্য, অন্ধকার দিকগুলো বার বার উঠে এসেছে তাদের লেখনীতে। সামাজিক স্থিতিজাড্য, নিয়ন্ত্রিত জীবনচর্চার বিপ্রতীপ অবস্থানে তারা আস্থা রেখেছিলেন। অস্থিরতা, তীব্র সংঘাত ইত্যাদির ভিতর দিয়ে গূঢ় উপলব্ধি স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন পাঠবস্তুকে। তার সংগে মিশিয়েছেন উত্তরবঙ্গের লৌকিক যাদুবাস্তবতা, লোকজীবনের বর্ণময় জগৎ।
0 Comments
মন্তব্যের দায় মন্তব্যকারীর, সম্পাদকের নয়।